0
সন্তানের জন্য পৃথিবীতে আল্লাহ তা’য়ালার পর সবচে আপন এবং শ্রদ্ধেয়-তার পিতা- মাতা। আল্লাহ নিজেও কোরআনে হাকিমে মাতা-পিতা সম্পর্কে বলেছেন-‘আর তোমাদের প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত-অনুগত্য করো না এবং পিতা-মাতার সাথে উত্তম ব্যবহার করো; যদি তাঁদের একজন বা উভয়ই তোমাদের সামনে বার্ধক্যে উপনীত হন তবে তুমি তাঁদের প্রতি উহঃ (ঘৃণা বা দুঃখ ব্যঞ্জক) শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বলো তাদেরকে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা। এবং তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে নম্রভাবে বাহু নত করে দাও এবং (আল্লাহ পাককে) বলো-হে আমার মালিক! তাঁরা (অর্থাৎ পিতা মাতা) শৈশবে আমাকে যেভাবে স্নেহ-যতেœ লালন-পালন করেছেন, তুমিও তাঁদের প্রতি সেভাবে সদয় হও’। (সুরা-বনী ইসলাঈল-২৩-২৪) 


মুফাচ্ছির-এ-কোরআনেরা পিতা-মাতার আনুগত্য বলতে এই বুঝিয়েছেন-‘তাঁরা যাতে সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারেন সেদিকে সন্তানের সুদৃষ্টি রাখা এবং সন্তানের এমন কোনো কাজ না করা যার দ্বারা পিতা-মাতার মনে আঘাত আসে। এবং তাঁদের ইসলামসম্মত সমস্ত আদেশ-নিষেধ পালন করা। যদি তাঁরা ইসলাম বিরোধী কোনো আদেশ দেন অথবা শক্তি প্রয়োগ করেন তাহলে সন্তান পিতা-মাতার আদেশ অমান্য করে আল্লাহর বিধান মান্য করবে। কিন্তু এমতাবস্থায়ও তাঁদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করতে হবে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক বলেন-
‘যদি তাঁরা (পিতা-মাতা) তোমাদের উপর চাপ প্রয়োগ করে আমার সাথে কাউকে শরীক করার জন্য যা (শিরক) তোমার বোধগম্য নয়, তাহলে তুমি তাঁদের কথা অমান্য করো, (অর্থাৎ আমি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না) আর পার্থিব জীবনে উৎকৃষ্ট পন্থায় তাঁদের সাথে সৎ সম্পর্ক বজায় রেখো। আর তুমি তাঁদের পথ অনুসরণ করো যারা (আমি এক) আমার প্রতি অবিচলভাবে আকৃষ্ট রয়েছে।’ (সূরা লুকমান : আয়াত ১৫) 
এই আয়াত দ্বারা সহজে বুঝা যায়, পিতা-মাতা যদি ইসলাম বিরোধী আদেশ দেন তবে তা অমান্য করতে হবে কিন্তু তাঁদের প্রতি অসৎ ব্যবহার করা চলবে না। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন হযরত ইব্রাহীম (আ.)। এছাড়াও আরো বহু উদাহরণ মহাপুরুষদের জীবনীতে পাওয়া যায়। 
পিতা-মাতার মর্যাদা বলতে গিয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন-‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেস্ত’-(আল হাদিস)। তিনি আরো বলেন-‘পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি, পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।’ কাজেই বেহেস্তে যেতে হলে অবশ্যই তাঁদের সেবা করতে হবে এবং তাদের অনুগত থাকতে হবে। 
ইসলাম পিতা-মাতার ব্যাপারে সন্তানকে এতো সাবধান করার পরও দুঃখ হয়, যখন দেখি কোনো জালেম সন্তানের কাছে নিজ পিতা-মাতা তার নিষ্ঠুর দুর্ব্যবহারে মজলুম অথবা কোনো বাবা-মা সন্তানের অসৎ ব্যবহারের বিচার প্রার্থী হয়, অথবা কোনো সন্তান তাঁর জন্মদাতা পিতা-মাতাকে তিরস্কার করে কথা বলে। 
বর্তমানে এই জঘণ্য সংস্কৃতি আমাদের সমাজেও দেখা যায়, অসংখ্য বাঙালী, এমন কি মুসলিম পিতা-মাতার কাছ থেকেও নিজ সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনা যায়, কথা না শুনা ও অবাধ্যতার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওদের আচরণ জাহেলী যুগকে হার মানিয়ে দেয়। আফসোস হয় ওদের জন্য। ইসলাম এতো সাবধানবাণী উচ্চারণ করার পরও মুসলমান সন্তানদের কমপক্ষে এমন হওয়ার কথা ছিল না, তবুও হচ্ছে। বর্তমানে মুসলিম পরিবারগুলোতেও শত শত বাবা-মা লাঞ্ছিত হচ্ছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। বাঙালী হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ সমাজে এগুলো নিকট অতীতেও তেমন ছিলো না, কিন্তু বর্তমানে অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেনো এমন হচ্ছে? এর জন্য কি শুধু একা সন্তান দায়ী, না পিতা-মাতার দায় আছে? 
এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো, সন্তান তো অবশ্যই দায়ী। কিন্তু পিতা-মাতাও অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত দায়ী। সমাজে প্রচলিত একটি কথা আছে-‘সন্তান জন্ম দেওয়া যতো সহজ, মা-বাবা হওয়া ততো সহজ নয়’।'
ইসলাম মানব জাতিকে পরিস্কার ভাষায় বলে দিয়েছে, কিভাবে গড়ে তুলতে হয় সন্তানকে এবং কিভাবে সন্তানের প্রকৃত বাবা-মা হওয়ার কর্তব্য পালন করা যায়। যারা প্রকৃত বাবা-মা হতে চান, তাঁরা সন্তান মাতৃগর্ভে থাকাকালিন সময় থেকে সন্তানকে সন্তান হিসাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু করেন। সন্তান গর্ভে আসার সাথে সাথে পিতা-মাতাকে নানাবিধ সতর্কতা ও দায়িত্ব পালন করতে হয়। যেমন-সন্তানের মাকে তাঁর স্বাস্থ্য, মন ও মানসিকতাকে সুস্থ এবং পবিত্র রাখতে হয়। হালাল খাওয়া, কোরআন-হাদিস এবং উত্তম বই পড়া এবং যারা পড়তে পারেন না তারা যেকোনো ভাবে শোনা, সব সময় আদর্শ আর মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী পাঠ ও আলোচনার মাধ্যমে নিজের অন্তকরণ ও সত্ত্বাকে পবিত্র এবং প্রফুল্ল করে তুলতে হবে, কারণ এই সময় মায়ের মনে এবং বাস্তব জীবন-চরিত্রে যা প্রকাশ পাবে তা সন্তানের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে ভবিষ্যতে সন্তানের চরিত্রে প্রভাব বিস্তার করা স্বাভাবিক। যার বাস্তব অনেকগুলো প্রমাণ আমরা বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানীর (রা.) জীবনী সহ মহান ব্যক্তিদের জীবনী পড়লে পেয়ে থাকি। 
সন্তান মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় পিতার জন্য কর্তব্য হলো, সন্তানের কল্যাণার্থে তাঁর মায়ের স্বাস্থ্য রার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা। আর সন্তান ভূমিষ্ট হবার পর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বের কাজ, যেমন-উত্তম ইসলামি নাম রাখা। হয়তো কারো প্রশ্ন হতে পারে, নামে কি আসে যায়? কিন্তু উলামাদের মতে, নাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ হাদিসে রাসূলে এসেছে-‘পরকালে মহান আল্লাহ পাক শেষ পর্যন্ত জাহান্নাম থেকে নাম ডেকে ডেকে মুক্তি দেবেন। যাদের নাম ইসলামি হবে সে সময় তাঁরাও মুক্তি পাবে। 
এছাড়া বর্তমান পৃথিবীতেও নামের অনেক গুণ আছে। যেমন-আমাদের ইমাম হযরত আবু হানিফা (রা.)-এর সময় একজন ইহুদী তিরস্কার করে তার একটি ষাড়ের নাম রেখে ছিলো আবু বকর এবং অপরটির নাম দিয়েছিলো উমর। একদিন এই ব্যক্তি তাঁর নিজ ষাঁড়ের আঘাতে মারা গেলো। এই সংবাদ ইমাম সাহেবের কাছে পৌঁছলে তিনি সংবাদদাতাকে বললেন, নিশ্চয় উমর নামের ষাঁড়টি এই ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, সংবাদদাতা হ্যাঁ বললে ইমাম সাহেব বললেন-দেখো নামের কত আছর! এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত আবু বকর (রা.) অত্যন্ত শান্ত ও কোমল হৃদয়ী ছিলেন, তাই ইমাম সাহেবের বিশ্বাস ছিলো আবু বকর নামের ষাঁড়টিও শান্ত হৃদয়ী হবে। অন্যদিকে হযরত উমর (রা.) ছিলেন অত্যন্ত তেজস্বী, তাই উমর নামের ষাঁড়টিও নিশ্চয় তেজস্বী হবে। 
এছাড়াও নামের গুরুত্ব নিয়ে আরো বহু ঘটনা আছে যা এখানে উল্লেখ করা বাহুল্য হবে। তাই সন্তানের নাম আজে-বাজে না রেখে উত্তম নাম রাখা পিতা-মাতার জন্য জরুরী। এরপর যদি সম্ভব হয় তবে আকীকা দেয়া। সন্তানকে যতœ এবং স্নেহের সোহাগে লালন-পালন করা। সন্তানের যখন শিক্ষা জীবন শুরু হয় তখন মা-বাবার জন্য জরুরী সন্তানকে সুশিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা। সন্তানকে সুশিক্ষা দেয়া বাবা-মার সর্বপ্রধান কর্তব্য। শিশুমন অত্যন্ত কোমল ও অনুকরণপ্রিয়, এই সময় যে শিক্ষা দেয়া হয় তা শিশু মনে অতি সহজেই অংকিত হয়ে যায়। এই সময় পিতা-মাতাকে নিজেদের কথা-বার্তা, আচার-আচরণে সীমা রাখতে হবে। কারণ এই সময়টি সন্তানের জন্য অত্যন্ত নাজুক। তাঁরা যা দেখে বা শোনে, তা সহজে রপ্ত করে নেয় এবং এই শিক্ষা তাঁর ভবিষ্যত জীবনে সাংঘাতিক প্রভাব ফেলে। সন্তানকে সব সময় শান্ত ভাষায় ভদ্রভাবে উত্তম উপদেশ দিতে হবে। যেমন আমরা দেখতে পাই হযরত লুকমান (আ.) তাঁর সন্তানদেরকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন-
‘হে আমার সন্তান। তুমি নামাজ কায়েম করো, (লোকদেরকে) সৎ কাজের আদেশ দাও এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করো আর যে বিপদ আসবে, তাতে ধৈর্য ধারণ করো। নিশ্চয় তা (বিপদে ধৈর্য্য ধারণ) অত্যন্ত দৃঢ় সংকল্পের কাজ’। (সূরা-লুকমান-১৭)
সুশিক্ষা বলতে উলামাগণ বলেন ধর্মীয় শিক্ষার কথা। হয়তো কেউ প্রশ্ন করতে পারেন ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া বাকীগুলো কি কু-শিক্ষা? যদিও ‘সু’ শব্দের বিপরীত শব্দ ‘কু’ কিন্তু এখানে তা প্রযোজ্য নয়। কারণ যে সমস্ত কাজ মানুষের জীবনের জন্য অপরিহার্য তার শিক্ষা করাও প্রয়োজন বা জরুরী। কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া অন্য কোনো শিক্ষায় চরিত্র গঠনের উত্তম কোনো পথ বর্তমানে রাখা হয়নি। ধর্মীয় শিক্ষা দ্বারা মানুষ প্রেম, ভালবাসা ও মানবতা শেখে। আর বাকি শিক্ষা দ্বারা মানুষ তার প্রয়োজন মেটায়। ইউরোপ, আমেরিকার স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার দিকে নজর দিয়ে দেখুন ‘আদবের’ উপর কোনো কাস আছে কি না? এই সমস্ত দেশের স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সন্তানগণ শুধু একটি কথা শিক্ষা করে ‘আমি’ ‘অর্থাৎ, আমি এই, আমি সেই ইত্যাদি। কোথাও ‘আমাদের’ বলা হয় না। ‘আমি এবং আমার শব্দ’ শিক্ষায় অহংকার ছাড়া কোনো মানবতা বা আদবের নামগন্ধও থাকে না। অহংকার না করার উপদেশ ইসলাম বার বার দিয়েছে, কোরআনের ঘোষণা- 
‘অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্ব ভরে পদচারণা করো না, নিশ্চয় আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না’। (সূরা-লুকমান-১৮)
যে শিক্ষায় ‘আমরা’ শব্দ ব্যবহার হয় সেখানে সামান্য হলেও মানবতা বা আদব পাওয়া যায়। ইউরোপ, আমেরিকার কথা বাদ দিলাম। কারণ, একে তো তারা মুসলমান নয়; অপরদিকে এশিয়ানদের মতো তারা সামাজবদ্ধও নয়। বাংলাদেশের কাস ওয়ান থেকে আগডুম, বাগডুম দিয়ে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যে জ্ঞান শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, এর মধ্যে কয়টি কাস আদব বা মানবতার? আমরা অবশ্য এই সমস্ত শিক্ষাকে তিরস্কার করছি না, কারণ এগুলোও প্রয়োজনীয়; কিন্তু এগুলোর সাথে সাথে কিছু আদব এবং মানবতা শিক্ষার প্রয়োজন কি ছিলো না? 
অপরদিকে ধমীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-মাদ্রাসায় গিয়ে দেখুন, মক্তব থেকে দাওরা হাদিস পর্যন্ত বেশির ভাগ কিতাব আদব আর মানবতার উপর। তাই উলামাগণ সন্তানের চরিত্র গঠনের ব্যাপারে সুশিক্ষা বলতে ধর্মীয় শিক্ষার কথা বলে থাকেন। সন্তান জন্ম হবার পর থেকে পূর্ণপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন, পানাহার, পোশাক-পরিচ্ছেদ, শিক্ষা-দীক্ষা ও চরিত্র গঠন ইত্যাদির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। এই সমস্ত কর্তব্য যথাযথ ভাবে পালনের পরই সন্তানের প্রকৃত পিতা-মাতা হওয়া যায়। সুন্দর সমাজের জন্য উত্তম নাগরিক কেবল বাবা-মার সর্বোচ্চ সতর্কতাও উত্তম তত্ত্বাবধান গড়ে উঠতে পারে। ইসলাম চরিত্রগঠনের উত্তম মাধ্যম। এছাড়া যা আছে সবই মরিচীকার চাকচিক্যময় ধোকা ছাড়া আর কিছুই না।

Post a Comment

 
Top